প্রকৃত নাম ছিল ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে। ধর্মান্তরিত নাম মোহাম্মদ আলী। তিন তিনবার তিনি বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। তিনি ১৯৬৪ সালে আমেরিকার মুসলিম সংগঠন নেশন অব ইসলামে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালে ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতার কারণে গ্রেফতার হন এবং তার বক্সিং খেতাব কেড়ে নেয়া হয়। শুধু কি তাই, তার বক্সিং লাইসেন্সও স্থগিত করা হয়।
মোহাম্মদ আলী ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি কেন্টাকি রাজ্যের লুইসভিলে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে সিনিয়র ও মাতার নাম ওডিসা গ্রেডি ক্লে। বাবা বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ড লিখতেন, মা ছিলেন গৃহিণী। লুইসভিলের এক জো ই মার্টিন নামক পুলিশ অফিসারের সহযোগিতায় তিনি ছোটবেলা থেকেই বক্সিংয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি বক্সিং মাস্টার ফ্রেড স্টোনার ও চাক বোডাক এর কাছেও প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৬০ সালে রোমে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীণ অলিম্পিকে লাইট হেভিওয়েটে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেন, এক শ্বেতাঙ্গ রেস্টুরেন্টে কালো বলে তিনি সার্ভিস পাননি। এই ক্ষোভে তিনি তার অলিম্পিক স্বর্ণপদক ওহাইও নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। পরে ১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিকে সেই স্বর্ণপদক ফিরিয়ে দেয়া হয়।
তিনি বক্সিংয়ে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সাধারণত বক্সিংয়ে হাত উঁচিয়ে রেখে মুখ বাঁচানো হতো। তিনি হাত মুখমন্ডলের নিচে এবং পা দুটো কে চলমান রেখে ক্ষিপ্রতার সাথে বিপক্ষের ঘুষি থেকে মুখ রক্ষা করতেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সার পর্যন্ত তিনি অভাবিত ও অভূতপূর্ব রেকর্ড করলেন। ১৯ টি মুষ্টিযুদ্ধের ১৯টিতেই জয় পেলেন, যার ১৫ টি নক আউট। এই চার বছরে তিনি একে একে হারালেন টনি স্পারটি, জিম রবিনসন, অ্যালোঞ্জো জনসন, ল্যামার ক্লার্ক,জর্জ লোগান ডাউক জোন্স, হেনরি কুপার প্রমুখকে।
১৯৬৪ সালে লিখন ও বানান দুর্বলতার কারণে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীতে তিনি প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু পরের বছর তার পরীক্ষা নেয়া হয়,তিনি এ ওয়ান শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। সেই সময় আমেরিকা ভিয়েতনামে যুদ্ধ করছিল। ভিয়েতনামে যুদ্ধের জন্য তাকে মনোনয়ন দেয়া হলে তিনি যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, "যুদ্ধ পবিত্র কোরান শিক্ষার বিরোধী। আমি এ যুদ্ধে সামিল হতে পারি না। আমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের অনুমতি ছাড়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারি না। কোন খৃস্টানের কিংবা অবিশ্বাসীদের যুদ্ধে শরিক হওয়া আমাদের উচিত হবে না।" তিনি আরও বলেন, "তাদের (ভিয়েতনামীদের) সাথে আমার কোন বিবাদ নেই। তারা (ভিয়েতনামীরা) আমাকে কালো বলে গাল দেয় নি।অন্যত্র তিনি বলেন," তারা (মার্কিনিরা) কেন আমাকে উর্দি পরিয়ে দশ হাজার মাইল দূরে পাঠিয়ে ভিয়েতনামীদের উপর বোমা আর বুলেট মারতে বলবে যখন লুইসভিলেই (আলীর গ্রাম) সামান্যতম মানবাধিকার অস্বীকার করে নিগ্রোদের সাথে কুকুরের মত আচরণ করা হয়।"
১৯৬৪ সালে আলী প্রকাশ করলেন যে, তিনি Nation
of Islam এর সদস্য হয়েছেন। তখন তার নাম দেয়া হয় ক্যাসিয়াস এঙ্ ( ক্লে বাদ দিয়ে)। ক্লে ছিল তার ক্রীতদাস পূর্ব পুরুষদের খেতাব। তার ভাই রুডি ক্লে তারও আগে ১৯৬১ সালের দিকে মুসলমান হন। আলীর Nation of Islam এ প্রবেশ দেশে বিদেশে অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। আলীর স্পষ্টবাদিতাও তাকে ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন করল। তবে তিনি সাহসিকতার সাথে সবকিছু মোকাবেলা করেন। ১৯৭৫ সালে আলী সুন্নি মুসলমানে দীক্ষিত হন। Howard University ‘র চার হাজার উৎফুল্ল ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় তিনি বলেন, "Black Is Best".
ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতির কারণে তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৬৭ সালের ২০ জুন মাত্র ২১ মিনিটের বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপীল করা হয়। ইতোমধ্যে আলীর সমর্থনে ও যুদ্ধের বিপক্ষে জনমত তীব্রতর হতে শুরু করে। আলী তার সমর্থনে সারাদেশব্যাপী যুদ্ধবিরোধী মনোভাবসম্পন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বক্তৃতাদান অব্যাহত রাখেন। পরে আদালত রায় পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হন।
১৯৮৪ সালে আলীর পারকিসন্স রোগ ধরা পড়ে। তিনি ৬১ টি বক্সিং প্রতিযোগিতার মধ্যে ৫৬ টিতে জয়ী হন। মাত্র ০৫ টিতে পরাজিত হন। যাদের তিনি পরাজিত করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন-লিয়ন স্পিংস্, জো ফ্রেজিয়ার, জর্জ ফোরম্যান, লিয়ন স্পিংস্, কেন নরটন, হেনরী কুপার, সনি লিসটন। যাদের কাছে হেরেছেন- ট্রেভর বারবিক, ল্যারি হোমস, লিয়ন স্পিংস্, কেন নরটন ও জো ফ্রেজিয়ার।
তিনি অনেক বিরল সম্মান আর পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৩ সালে আমেরিকার ৮০০ জীবিত অথবা মৃত অ্যাটলেটের মধ্যে বেইব রুথের সাথে তাকে যুগ্মভাবে সেরা ঘোষণা করা হয়। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় তিনি ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সাথে দেখা করে আমেরিকান জিম্মিদের মুক্ত করে আনেন। ১৯৯৬ সালে তাকে বিশ্বের সেরা আমেরিকান ঘোষণা করে 'স্পিরিট অব আমেরিকান' পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। একই বছর তিনি ১৯৯৬ গ্রীষ্মকালীণ অলিম্পিক শিখা প্রজ্জ্বলন করেন। ১৯৯৯ সালে বিবিসির ভোটে 'শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ' মনোনীত হন। ২০০৫ সালের ৮ জানুয়ারি জর্জ বুশ তাকে 'প্রেসিডেন্সিয়াল সিটিজেন মেডেল' পরিয়ে দেন। ২০০৫ সালের ৯ নভেম্বর হোয়াইট হাউস এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে 'প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম' প্রদান করে। তিনি অবসরে যাবার পর বিভিন্ন মানবতাবাদী কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্তি, সবার জন্য শিক্ষা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সমঝোতা উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। রিচার্ড দুরহাম-এর সাথে তিনি ১৯৭৫ সালে লেখেন তার আত্মজীবনী গ্রন্থ The Greatest: My Own Story.
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন