উপলব্ধি (২)
কবির আহমেদ
২
পরের দিন সকালে বশির যথারীতি দোকান খোলে। হঠাৎ চেয়ে দেখে বৃদ্ধ দূরের কুয়াশাচ্ছন্ন
পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তার জীবন সায়াহ্নের অশেষ ক্লান্তি। দু’গালে অশ্রুর শুকিয়ে যাওয়া চিহ্ন। সারারাত কেঁদেছে। আশা করেছে সকালে ছেলে আসবে , তাকে নিয়ে যাবে। কিন' জীবনের স্রোত তো আর কারো নিজস্ব ছকে বাঁধা নিয়মে চলবে না। নিয়তি তার আপন অহমিকায় হরহামেশাই মানুষের সাজানো গুছানো ডেরাকে তছনছ করবেই। আর মানুষ আবারো মনের মাধুরি মিশিয়ে তার ঘর-আঙিনা গোছাবে। আশা আর বিশ্বাসের চোরাবালিতেই পা রাখবে।
বৃদ্ধের ছিল সাজানো বাগান। একমাত্র সন্তানকে সর্বোত্তম ত্যাগে মানুষ করেছে। কখনো কোনো আঁচড় লাগতে দেয় নি। যখন যা চেয়েছে দিয়েছে। শহরের সবচেয়ে নামী স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করিয়েছে।
মা-বাবা তো কোনো বিনিময়ের আশায় সন্তানকে বড় করে না। সনত্মানের জন্য সবচেয়ে ভালোটা নির্বাচন করে। অথচ সন্তান আজ কী দিয়েছে? বোঝা মনে করে পরিত্যাগ করেছে। প্রতারণা করে , ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে শেয়াল কুকুর মনে করে ফেলে দিয়ে গেছে।
দুবেলা আহার পর্যন্ত ঠিকমতো দেয় নি। কত সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ পেয়েছে নাকে, অথচ পেস্নটে পেয়েছে বাসি নরম ভাত, বাসি ব্যঞ্জন। প্রথম প্রথম মনে করেছে, ঘ্রাণশক্তি হয়তো লোপ পেয়েছে। অথবা বুড়ো বয়সের ভ্রম,ভীমরতি। আস্তে আস্তে সে ভ্রম কেটেছে। আজ তো দিনের আলোর মতো সব পরিস্কার। তবুও সব কিছু স্বপ্ন মনে করে সে ভুলে যেতে চায়।
বশিরের জীবন থেকেও হারিয়ে গেছে নুরি। যাকে প্রাণপণ ভাবেসেছিল সে। যার মায়াময় মুখটাতে পৃথিবীর সমস্ত সুখ এসে জড়ো হয়েছিল। যে মুখ দেখলে তৃষ্ণা মিটে যেত , চাঁদকে দেখার আগ্রহ নিভে যেত। অথচ আজ ...... । দক্ষিণের তালপুকুরের আশপাশ এখনো গুঙরে ওঠে নুরির স্মৃতিতে। একদিন হঠাৎ নুরি অসুস্থ হয়ে পড়ল। খবর পেতেই দ্রুত ধাবমান ঘোড়ার মতন ত্বরিত গিয়ে দেখল উঠোনে নুরি মৃতবৎ শায়িত। হাত পা ঠাণ্ডা। আকাশ ভেঙে পড়ল।কানে শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ হচ্ছিল। বশিরের মাথায় কিছুই কাজ করছিল না।নুরির মাকে হাতে পায়ে তেল মাখতে বলে মিনিট দশেকের মধ্যে ভ্যান নিয়ে আসে সে। ভ্যানে করে সেই অমাবশ্যার অন্ধকারে নিয়ে যায় হাসপাতালে। বিয়ের জন্য জমানো সমসত্ম টাকা ঢেলে দিয়ে বাঁচাতে পেরেছিল নুরিকে।
বশির আজ ভাবে, ‘মানুষ এত স্বার্থপর অমানুষ হয় ক্যামনে।’ নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন্ন করে উত্তর খুঁজে পেতে ভীষণ কষ্ট হয় । সেই কষ্ট বুকের মাঝখানটাতে এখনো পাথরের মত চেপে আছে । যেদিন স্কুলের চাকরি চলে গেল, তারপর থেকে নুরির মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেল। প্রথম প্রথম বশির আমলে নেয় নি।
একদিন দুপুরে জয়নাল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে খবর দিল,‘তুই এহানে বইয়া রইছত, খবর কিছু রাখস?
‘ক্যান কি অইছে ?’-নির্বিকার বশিরের প্রশ্ন।তবে ভেতরে ভেতরে সে বেশ ভয় পেয়েছে। কারণ জয়নাল যে কেনো কথা নাটকীয় বা অতি নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে ঠিকই ,তবে তার কথায় সত্যতা থাকে।
জয়নাল যা বলল তার সারমর্ম এই, আজ কাক ডাকা ভোরে কাদের ভ্যানওয়ালার সাথে নুরি পগার পাড়ি দিয়েছে। বশিরের মনে হয়েছে কে যেন গরম শিসা ঢেলে তার দুই কান স্তব্ধ করে দিয়েছে। তার দম বন্ধ হয়ে এল। চিৎকার করে সে কেঁদে উঠল । সারা উঠোনে সে শিশুর মত হাত পা ছুঁড়ে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছে।
প্রিয়জন নির্মমভাবে ছেড়ে চলে গেলে কেমন অনুভূত হয়, বশির তা মর্মে মর্মে টের পায়। বৃদ্ধের জন্য তাই তার মায়া হয়। বিবমিষায় তেতো হয়ে ওঠে অন্তর। সাথে সাথে তার নিস্তরঙ্গ জীবন-নদে বিক্ষুব্ধ দোলা লাগে,বুকের পুরনো ব্যথা টনটন করে জেগে ওঠে।
মানুষ কখনো অস্তায়মান সূর্যকে প্রণতি জানায় না।এ কথা নির্জলা সত্য।এ সমাজ শুধু অর্থবান আর শক্তিমানদের শ্রদ্ধা করে। আজ বৃদ্ধ ও বশির জীবন্মৃত। এ সমাজে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। অর্থ ,ক্ষমতা তাদের নেই। অবজ্ঞা আর অপ্রীতি তাদের প্রাপ্য। তাদের প্রিয়জনেরা তা দিতে কুণ্ঠাবোধ করে নি। জীবনের শেষ বেলায় তাদের উপলব্ধি - সত্যিকার মানুষ যাকে ভালবাসার তাকে ভালবাসবেই। আর বিনিময়ে স্বার্থগৃধ্নুরা তাদের ঘৃণ্য লোলুপতা প্রদর্শন করে প্রিয়জনদের ত্যাগ করবে , কষ্ট দেবে। তাই বলে পৃথিবীতে ভালবাসার স্রোতবতী নদীর নিরন্তর পথচলা তো আর থেমে যাবে না।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন