উপলব্ধি (১)
১.
বৃদ্ধের সারা গাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। তাকে ঘিরে জনা পাঁচেক উৎসুক জনতার ভিড়। সবার মনে প্রশ্ন-এমন জায়গায় এই অশীতিপর বৃদ্ধ কেন একা বসে আছে? পথ ভুলে যায় নি তো? তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা,চোখে শক্তিমান লেন্সের পুরু চশমা। রাস্তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। মনে হয় ঐ রাস্তায় জীবনের মূল্যবান কিছু ফেলে এসেছে সে।
‘আপনের বাড়ি কই?’-ভিড়ের মধ্য থেকে একজন প্রশ্ন করল। বৃদ্ধ নির্বিকার। হয়তো শোনে নি অথবা উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করে নি। আবার কয়েক মিনিটের নিরবচ্ছিন্ন নিরবতা। ঘাম ঝরছে অবিরল। শীতের এই পড়ন্ত বিকেলে এমনভাবে ঘাম ঝরার কথা নয়।
‘এখানে কার বাড়িতে আইছেন? কতা কন না ক্যান?’- আরেকজন জিজ্ঞেস করল। এবার বৃদ্ধ নড়েচড়ে বসল যেন। রাস্তার দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল, একটু দম নিয়ে বলল-‘আমার বড় ছেলে আমাকে এখানে রেখে গেছে। ডাক্তারের কাছে আনছিল। কইল,‘এখানে বসেন। আমি এখনই আসতেছি।’
‘আপনের ছেলে কী করে?’
‘এনজিওতে চাকরি করে।’- ক্ষুধা-তৃষ্ণাতুর গলায় ঢোক গিলে বৃদ্ধ জবাব দিল।
‘থাকেন কই?’
‘মিরপুরে।’
‘ঘরে আর কে কে থাকে?’
‘বউ,দুই নাতি-নাতনি, আর আমার ছেলে অসীম।’
জড়ো হওয়া জনতার এমনি অনেক প্রশ্ন। তবে এ সকল প্রশ্নে বৃদ্ধের এখানে আসার কারণ উঠে এল না।
তবে এটা বুঝতে কষ্ট হল না যে, ছেলে কোন কু মতলবে বাবাকে এখানে এনেছে।
সন্ধ্যা সমাগত প্রায় । শীত তার চিরায়ত শীতলতা নিয়ে জেঁকে বসার আয়োজন করছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে তাদের ঘরে ফেরার জানান দিচ্ছে।
বৃদ্ধের পরনে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। পাশে একটি ছেঁড়া ব্যাগ।হারিয়ে ফেলার ভয়ে হোক অথবা ঠাণ্ডায় হোক বৃদ্ধ তার কুঁচকানো চামড়ার ডান হাতে ব্যাগটি আগলে রেখেছে।
‘চাচা মিয়া হুনেন,আমার মনে অয় আপনার পোলা আপনেরে ফালায়া গ্যাছে।’ - ভিড় থেকে একজন বলে উঠল। বাকি সবাই সমস্বরে সমর্থন জানাল।
বৃদ্ধ যেন প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। ছলছল করে উঠল তার চোখ। চশমার ভেতর থেকে তার বড় বড় চোখের দিকে একটু মনোনিবেশ করলে বোঝা যাবে অভিশাপদগ্ধ এই প্রৌঢ় জীবনের প্রতি তীব্র ঘৃণায়- লজ্জায় তার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
‘আরে উঠেন চাচা মিয়া। আমি বুঝছি আপনের পোলা আর আইবো না। আমি দোকান থাইক্যা দেখছি এক ব্যাডা আপনেরে এখানে রাইখ্যা জোরে জোরে হাইট্টা চইলা গেল। লন আমার দোকানে।’ ভিড় ঠেলে বশির ঢুকল।
বৃদ্ধ যেন কঁকিয়ে উঠল।
‘না না আমি গেলে অসীম এসে আমারে খুঁজব। সে অস্থির হয়ে যাবে।’
‘আর আইছে আপনের পোলা’- বলেই বশির অনেকটা জোর করে বৃদ্ধকে তার দোকানে নিয়ে গেল।
বৃদ্ধকে চা বিস্কুট দিল। বশির এক সময় এক বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করত। স্কুলের তালা খুলত, তালা লাগাত। ঘণ্টা বাজাত। বড় সুখের সময় ছিল তার। স্কুল ছিল বশিরের ধ্যান জ্ঞান। অতি ভালবাসা জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। আর তাইতো কপালে বেশিদিন সুখ সয় নি। স্কুলের জমিজমা নিয়ে একদিন মামলা হল।মামলা চলল আনেক দিন। একদিন আদালতের রায় হল। নজু মেম্বার তার দলবল নিয়ে বাঁশগাড়ি দিয়ে দখল নিল। স্কুলের বুক নয় , বশিরের বুকটাই যেন চিরে দিয়ে গেল। যে মাঠে কচিমনের শিশুরা গোল্লাছুট-ফুটবল খেলে দাপিয়ে বেড়াত ,আজ সেখানে আড়তের ধান শুকানো হয়। পরিবর্তনের হাওয়ায় যে ধানী জমিতে একদিন স্কুল হয়েছিল, সেখানে আজ সাহেবি খোলসে শুকনো ধান গড়াগড়ি খাচ্ছে।
‘তা চাচা মিয়া,অহন আপনের বিত্তান্ত হুনান।’- বশির বলল। ‘আপনের বউ পোলা কেমন আদর যত্ন করত?
বিষণ্ন মনে বৃদ্ধ এতক্ষণ দূর দিগন্তে তাকিয়ে ছিল। বশিরের কথায় তার ঘোর কাটল। দু’গাল বেয়ে অঝোরে নেমে এল শ্রাবণের ঢল। বলতে গিয়েও কোন কথা বের হল না। বুকের জমানো ব্যথায় আটকে গেল তার কথামালা।
‘বাদ দ্যান চাচা মিয়া। আমি বুইজা ফালাইছি।আপনে তো কইতে পারবেন না। পোলার মান সম্মানের কতা চিন্তা কইরা অফ যাইবেন। কিন' আপনাগো মত শিক্ষিত্ না অইলেও আমি বুজবার পারছি।’ জীবন যুদ্ধে পোড় খাওয়া বশির দার্শনিকের মতো মাথা নাড়ে আর স্বগতোক্তি করে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন