বৃদ্ধের সারা গাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। তাকে ঘিরে জনা পাঁচেক উৎসুক জনতার ভীড়। সবার মনে প্রশ্ন-এমন জায়গায় এই অশীতিপর বৃদ্ধ কেন একা বসে আছে? পথ ভুলে যায় নি তো? তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা, চোখে শক্তিমান লেন্সের পুরু চশমা। রাস্তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। মনে হয় ঐ রাস্তায় জীবনের মূল্যবান কিছু ফেলে এসেছে সে।
'আপনের বাড়ি কই?' ভিড়ের মধ্য থেকে একজন প্রশ্ন করল। বৃদ্ধ নির্বিকার। হয়তো শোনে নি অথবা উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করে নি।
আবার কয়েক মিনিটের নিরবচ্ছিন্ন নিরবতা। ঘাম ঝরছে অবিরল। শীতের এই পড়ন্ত বিকেলে এমনভাবে ঘাম ঝরার কথা নয়।
* এখানে কার বাড়িতে আইছেন? কতা কন না ক্যান?'- আরেকজন জিজ্ঞেস করল।
এবার বৃদ্ধ নড়েচড়ে বসল যেন। রাস্তার দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন, একটু দম নিয়ে বললেন- 'আমার বড় ছেলে আমাকে এখানে রেখে গেছে। ডাক্তারের কাছে এনেছিল। বলল, 'এখানে বসেন। আমি এখনই আসতেছি।'
'আপনের ছেলে কী করে?'
'এনজিওতে চাকরি করে।'- ক্ষুধা-তৃষ্ণাতুর গলায় ঢোক গিলে বৃদ্ধ জবাব দিল ।
'থাকেন কই?'
মিরপুরে।
'ঘরে আর কে কে থাকে?'
'বউ, দুই নাতি-নাতনি, আর আমার ছেলে অসীম।'
জড়ো হওয়া জনতার এমনি অনেক প্রশ্ন। তবে এ সকল প্রশ্নে বৃদ্ধের এখানে আসার কারণ উঠে এল না। তবে এটা বুঝতে কষ্ট হল না যে, ছেলে কোন কু মতলবে বাবাকে এখানে এনেছে।
সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। শীত তার চিরায়ত শীতলতা নিয়ে জেঁকে বসার আয়োজন করছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে তাদের ঘরে ফেরার জানান দিচ্ছে।
বৃদ্ধের পরনে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। পাশে একটি ছেঁড়া ব্যাগ হারিয়ে ফেলার ভয়ে হোক অথবা ঠাণ্ডায় হোক বৃদ্ধ তার কুঁচকানো চামড়ার ডান হাতে ব্যাগটি আগলে রেখেছে।
'চাচা মিয়া হুনেন, আমার মনে অয় আপনার পোলা আপনেরে ফালায়া গ্যাছে। ' ভিড় থেকে একজন বলে উঠল। বাকি সবাই সমস্বরে সমর্থন জানাল।
বৃদ্ধ যেন প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। ছলছল করে উঠল তার চোখ। চশমার ভেতর থেকে তার বড় বড় চোখের দিকে একটু মনোনিবেশ করলে বোঝা যাবে অভিশাপদগ্ধ এই প্রৌঢ় জীবনের প্রতি তীব্র
ঘৃণায় লজ্জায় তার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
'আরে উঠেন চাচা মিয়া। আমি বুঝছি আপনের পোলা আর আইবো না। আমি দোকান থাইক্যা দেখছি এক ব্যাডা আপনেরে এখানে রাইখ্যা জোরে জোরে হাইট্টা চইলা গেল। লন আমার দোকানে।'
ভিড় ঠেলে বশির ঢুকল।
বৃদ্ধ যেন কঁকিয়ে উঠল।
'না না আমি গেলে অসীম এসে আমারে খুঁজবে। সে অস্থির হয়ে যাবে।' “আর আইছে আপনের পোলা'- বলেই বশির অনেকটা জোর করে বৃদ্ধকে তার দোকানে নিয়ে গেল।
বৃদ্ধকে চা বিস্কুট দিল। বশির এক সময় এক বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করত। স্কুলের তালা খুলত, তালা লাগাত । ঘণ্টা বাজাত। বড় সুখের সময় ছিল তার। অকৃতদার বশিরের স্কুল ছিল ধ্যান জ্ঞান। অতি ভালবাসা জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। আর তাইতো কপালে বেশিদিন সুখ সয় নি। স্কুলের জমিজমা নিয়ে একদিন মামলা হল । মামলা চলল আনেক দিন।
একদিন আদালতের রায় হল। নজু মেম্বার
তার দলবল নিয়ে বাঁশগাড়ি দিয়ে দখল নিল। স্কুলের বুক নয়, বশিরের বুকটাই যেন চিরে দিয়ে গেল। যে মাঠে কচিমনের শিশুরা গোল্লাছুট-ফুটবল খেলে দাপিয়ে বেড়াত, আজ সেখানে আড়তের ধান শুকানো হয়। পরিবর্তনের হাওয়ায় যে ধানী জমিতে একদিন স্কুল হয়েছিল, সেখানে আজ সাহেবি খোলসে শুকনো ধান গড়াগড়ি খাচ্ছে ।
'তা চাচা মিয়া,অহন আপনের বিত্তান্ত হুনান।- বশির বলল। 'আপনের বউ পোলা কেমন আদর যত্ন করত?
বিষণ্ণ মনে বৃদ্ধ এতক্ষণ দূর দিগন্তে তাকিয়ে ছিল। বশিরের কথায় তার ঘোর কাটল। দু'গাল বেয়ে অঝোরে নেমে এল শ্রাবণের ঢল। বলতে গিয়েও কোন কথা বের হল না। বুকের জমানো ব্যথায় আটকে গেল তার কথা ।
“বাদ দ্যান চাচা মিয়া। আমি বুইজা ফালাইছি । আপনে তো কইতে পারবেন না। পোলার মান সম্মানের কতা চিন্তা কইরা অফ যাইবেন। কিন্তু আপনাগো মত শিক্ষিত না অইলেও আমি বুজবার পারছি।' জীবন যুদ্ধে পোড় খাওয়া বশির দার্শনিকের মতো মাথা নাড়ে আর স্বগতোক্তি করে।
পরের দিন সকালে যথারীতি দোকান খোলে। হঠাৎ চেয়ে দেখে সে দূরের কুয়াশাচ্ছন্ন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তার জীবন সায়াহ্নের অশেষ ক্লান্তি। দু'গালে অশ্রুর শুকিয়ে যাওয়া চিহ্ন। সারারাত কেঁদেছে। আশা করেছে সকালে ছেলে আসবে, তাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু জীবনের স্রোত তো আর কারো নিজস্ব ছকে বাঁধা নিয়মে চলবে না। নিয়তি তার আপন অহমিকায় হরহামেশাই মানুষের সাজানো গুছানো ডেরাকে তছনছ করবেই। আর মানুষ আবারো মনের মাধুরি মিশিয়ে তার ঘর আঙিনা গোছাবে। আশা আর বিশ্বাসের চোরাবালিতেই পা রাখবে।
বৃদ্ধের ছিল সাজানো বাগান। একমাত্র সন্তানকে সর্বোত্তম ত্যাগে মানুষ করেছে। কখনো কোনো আঁচড় লাগতে দেয় নি। যখন যা চেয়েছে দিয়েছে। শহরের সবচেয়ে নামী স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করিয়েছে। মা-বাবা তো কোনো বিনিময়ের আশায় সন্তানকে বড় করে না। সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভালোটা নির্বাচন করে। অথচ সন্তান আজ কী দিয়েছে? বোঝা মনে করে পরিত্যাগ করেছে। প্রতারণা করে, ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে শেয়াল কুকুর মনে করে ফেলে দিয়ে গেছে। দুবেলা আহার পর্যন্ত ঠিকমতো দেয় নি। কত সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ পেয়েছে নাকে, অথচ প্লেটে পেয়েছে বাসি নরম ভাত, বাসি ব্যঞ্জন। প্রথম প্রথম মনে করেছে, ঘ্রাণশক্তি হয়তো লোপ পেয়েছে। অথবা বুড়ো বয়সের ভ্রম,ভীমরতি । আস্তে আস্তে সে ভ্রম কেটেছে। আজ তো দিনের আলোর মতো সব পরিস্কার। তবুও সব কিছু স্বপ্ন মনে করে সে ভুলে যেতে চায়।
বশিরের জীবন থেকেও হারিয়ে গেছে নুরি। যাকে প্রাণপণ ভাবেসেছিল সে। যার মায়াময় মুখটাতে পৃথিবীর সমস্ত সুখ এসে জড়ো হয়েছিল। যে মুখ দেখলে তৃষ্ণা মিটে যেত, চাঁদকে দেখার আগ্রহ নিভে যেত। অথচ আজ । দক্ষিণের তালপুকুরের আশপাশ এখনো শুভরে ওঠে নুরির স্মৃতিতে। একদিন হঠাৎ নুরি অসুস্থ হয়ে পড়ল। খবর পেতেই দ্রুত ধাবমান ঘোড়ার মতন ত্বরিৎ গিয়ে দেখল উঠোনে নুরি মৃতবৎ শায়িত। হাত পা ঠাণ্ডা। আকাশ ভেঙে পড়ল । কানে শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ হচ্ছিল। বশিরের মাথায় কিছুই কাজ করছিল না । নুরির মাকে হাতে পায়ে তেল মাখতে বলে মিনিট দশেকের মধ্যে ভ্যান
নিয়ে আসে । ভ্যানে করে সেই অমাবশ্যার অন্ধকারে নিয়ে যায় হাসপাতালে। বিয়ের জন্য জমানো সমস্ত টাকা ঢেলে দিয়ে বাঁচাতে পেরেছিল নুরিকে ।
বশির আজ ভাবে, 'মানুষ এত স্বার্থপর,অমানুষ হয় ক্যামনে!' নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজে পেতে ভীষণ কষ্ট হয় । সেই কষ্ট বুকের মাঝখানটাতে এখনো পাথরের মত চেপে আছে । যেদিন স্কুলের চাকরি চলে গেল, তারপর থেকে নুরির মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেল। প্রথম প্রথম বশির আমলে নেয় নি।
একদিন দুপুরে জয়নাল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে খবর দিল, 'তুই এহানে বইয়া রইছত, খবর কিছু রাখস? “ক্যান কি অইছে ?’-নির্বিকার বশিরের প্রশ্ন । তবে ভেতরে ভেতরে সে বেশ ভয় পেয়েছে। কারণ জয়নাল যে কেনো কথা নাটকীয় বা অতি নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে ঠিকই, তবে তার কথায় সত্যতা থাকে। জয়নাল যা বলল তার সারমর্ম এই, আজ কাক ডাকা ভোরে কাদের ভ্যানওয়ালার সাথে নুরি পগার পাড়ি দিয়েছে। বশিরের মনে হয়েছে কে যেন গরম শিসা ঢেলে তার দুই কান স্তব্ধ করে দিয়েছে। তার দম বন্ধ হয়ে এল। চিৎকার করে সে কেঁদে উঠল । সারা উঠোনে সে শিশুর মত হাত পা ছুঁড়ে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছে।
প্রিয়জন নির্মমভাবে ছেড়ে চলে গেলে কেমন অনুভূত হয়, বশির তা মর্মে মর্মে টের পায়। বৃদ্ধের জন্য তাই তার মায়া হয়। সাথে সাথে তার নিস্তরঙ্গ জীবন- নদে বিক্ষুব্ধ দোলা লাগে,বুকের পুরনো ব্যথা টনটন করে জেগে ওঠে।
মানুষ কখনো অস্তায়মান সূর্যকে প্রণতি জানায় না। এ সমাজ শুধু অর্থবান আর শক্তিমানদের শ্রদ্ধা করে। আজ বৃদ্ধ ও বশির জীবন্মৃত। এ সমাজে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। অর্থ ক্ষমতা তাদের নেই। অবজ্ঞা আর অপ্রীতি তাদের প্রাপ্য। তাদের প্রিয়জনেরা তা দিতে কুণ্ঠাবোধ করে নি। জীবনের শেষ বেলায় তাদের উপলব্ধি—সত্যিকার মানুষ যাকে ভালবাসার তাকে ভালবাসবেই। আর বিনিময়ে স্বার্থগৃধ্নুরা তাদের ঘৃণ্য লোলুপতা প্রদর্শন করবেই। তাই বলে পৃথিবীতে ভালবাসার স্রোতবতী নদীর নিরন্তর পথচলা তো আর থেমে যাবে না।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন